ভাষার শ্লীল–অশ্লীলতায় বিপন্ন শৈশব
Share this content:
শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য

পঞ্চম শ্রেণির সবে দশে পা দেওয়া ছাত্রী, তাকে নিয়ে হুলুস্থুলু বিদ্যালয়! অভিভাবক থেকে শ্রেণি শিক্ষিকা সকলের দাবি এ মেয়েকে স্কুলে রাখা যাবে না। কী এমন গর্হিত কাজ করল ওইটুকুন নিষ্পাপ শিশুটি! সে নাকি সকলকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে! এ তো ভালো কথা নয়। সেই সময় প্রধান শিক্ষিকা থাকায় শিক্ষিকার কাছে জানতে চাইলাম কী বলছে মেয়েটি। তিনি জানালেন ও শব্দ তিনি উচ্চারণ করতে পারবেন না। ধন্দে পড়লাম। ভদ্রমহিলার জিভে কোন আড়ষ্টতা নেই, তবে এমন কী শব্দ যে উনি উচ্চারণ করতে পারবেন না? মেয়েটিকেই ডেকে পাঠালাম। প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বল একটি মেয়ে প্রবেশ করল।
প্রথম বার বড়দির চেম্বারে ঢুকতে পারার উত্তেজনা তার চোখে মুখে। বললাম তুমি এত ভালো মেয়ে হয়ে সকলকে বাজে কথা বলছ কেন ? এতটুকু অস্বস্তি বোধ না করে সে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কী বাজে কথা?’ ‘দিদিমণি তোমার ওপর রেগে গেছেন কেন ? তুমি বন্ধুদের কী বলেছো?’ সারাসরি প্রশ্ন করি। সে নির্দ্বিধায় বলে সে তো বন্ধুদের জিগ্যেস করছে “তুই কি খানকির বাচ্চা?” ও ওর বাড়ির জানালায় বসে পাশের কলতলায় জলের বালতি নিয়ে ঝগড়ার সময় একে অপরকে বলতে শুনেছে । ওর কানে বেশ লেগেছিল কথাটা। মাকে জিগ্যেস করতে গেছিল, ‘সে কি খানকির বাচ্চা?’
বেচারা মায়ের কাছে প্রচণ্ড মার খেয়ে বাড়িতে নিজের কৌতূহল অবদমন করে রেখেছিল। অগত্যা স্কুলকেই সে তার খোলা জানলা মনে করে বন্ধুদের প্রশ্ন করছিল, হয়তো বাক্যটি সমন্ধে একটি সম্যক ধারণা করতে চাইছিল। এটি একটি উদাহরণ মাত্র , এ রকম বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চিত আছে স্কুলের ঝোলায়। সমাজে সংসারে বড়রা নিজের রাগ মেটাতে অথবা নিছক ইয়ার্কি করে খিস্তি খেউর অবলীলায় ব্যবহার করেন, সামনে উপস্থিত শিশু সেই শব্দ বা বাক্যটিকে কীভাবে নিল, ভেবে দেখার দায় তাদের থাকে না। তবে শুধু যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া খিস্তি খেউর নয়, সমাজের অনেক স্তরের প্রচলিত কথ্য শব্দরাজিও প্রাতিষ্ঠানিক চৌহদ্দিতে মান্যতা পায় না।
সর্বশিক্ষার আঙিনায় এমনই কিছু শব্দ বিদ্যালয়ে শিশুদের মুখে শোনা যায় যা শহুরে কেতার মানুষদের কানে ভীষণরকম অপরিশীলিত লাগে। অথচ যে পরিবারে, পরিবেশে সে থাকে সেখানে সে শব্দগুলি যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। একদিন ক্লাসে একটি বাচ্চা দিদিমণিকে ‘ছোট টয়লেট’ যাবো না বলে ‘পেচ্ছাপ পেয়েছে’ বলায় ক্লাসে সহপাঠীদের কাছে এমন হেনস্থার শিকার হয়েছে ফল স্বরূপ স্কুলে পড়াকালীন একটি দিনের জন্যও সে টয়লেটে যায়নি। প্রস্রাব,পায়খানা যা সুস্থ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার অন্যতম মাপকাঠি, সেই শব্দ গুলোও জন সমক্ষে বলাতে শ্লীলতা লঙ্ঘিত হয়। শহুরে সভ্যতা আমাদের শ্রুতি যন্ত্রকে সেভাবেই বিবর্তিত করে নিয়েছে হয়ত। অথচ সেই শব্দ গুলোর ইংরাজি প্রতিশব্দ বলে আমরা শ্লাঘা অনুভব করি।
দেশে বিদেশে সব ভাষাতেই স্ল্যাং এর ব্যাবহার আছে। প্রশ্ন সেখানে নয়। খিস্তি-খেউর বা বিভিন্ন ভাষায় স্ল্যাং শব্দ ও তাদের উৎপত্তি নিয়ে বহু গবেষণাপত্র দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু শিশুরা যখন শব্দগুলি শুনে নিজেদের মত করে প্রয়োগ করে এবং ‘অশ্লীলতার দায়ে’ পড়ে তখন তো প্রশ্ন জাগবেই। আমাদের বিশাল শব্দ কোষে যে শব্দ গুলি মার্জিত অমার্জিত ভেদাভেদ ছাড়াই স্থান পেয়েছে, তারই কয়েকটি শব্দ ভাষার কোন বিকৃতির কারণে অমার্জিত, অশ্লীল হয়ে যায়, শব্দ ও অপশব্দে বিভাজিত হয় এবং বিপন্ন করে তোলে শৈশব, প্রশ্ন সেখানে।
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, ভালো একটি আলোচনা। সমস্যাটি আরও প্রকট হচ্ছে বেসরকারি বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টর, অটোরিক্সা চালক ও সাইকেল রিক্সা চালকদের জন্য। এইসব পরিবহন মাধ্যমগুলোতে প্রচুর বাচ্চা স্কুলে যাতায়াত করে, অথচ এইসব কন্ডাক্টর ড্রাইভার প্রমুখদের প্রায় প্রতি শব্দেই জড়িয়ে থাকে একাধিক অশ্লিল ও অসাংবিধানিক শব্দাবলী।